নেওড়া ভ্যালীতে চার রাত্রি
-মৃন্ময় চক্রবর্তী (লেখা
ও ছবি)
নেওড়া ভ্যালী ন্যাশনাল পার্ক, পশ্চিমবঙ্গের
কালিম্পং জেলায় আবস্থিত।
১৯৮৬ সালের এপ্রিল
মাসে এই উদ্যানটিকে সরকারিভাবে জাতীয় উদ্দ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ৮৮
বর্গকিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত এর পার্কটি নানান জাতীয় গাছপালা, পাখিতে
বেষ্টিত।
এমনই নানান পাখির খোঁজে আমরা, মানে আমি, আমার বন্ধু দীপ ও আমার শিক্ষক শ্রী
ভোলানাথ মাহাত সহ প্রায় ৩০ জনমত পৌঁছই ১২ই মার্চ ২০১৮তে। ছিলাম ওখানে চার রাত্রি।
এই সম্পূর্ণ বাবস্থাপনা ছিল HNAF (Himalayan Nature
& Adventure Foundation) এবং গরুমারা বনবিভাগের (Gorumara
Wild Division, Dept. of Forest, Govt. of West Bengal)।
১২ই মার্চ বেলা
২:৩০ ঘটিকায় ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্তায় আমরা পৌঁছই আমাদের লক্ষ্যে। সেদিনের বাকি
সময়টা বেশ আরাম ও বিশ্রামেই কাটাই মূলত ক্লান্তি ও বাইরের বৃষ্টির দরুন। বাইরে যেমন
ঠাণ্ডা তেমনই বৃষ্টি, মনে হয়েছিল যেন জমে যাচ্ছি। ১৩ই মার্চ, গতদিনের বৃষ্টি ভেজা
রাত কেটে ভোরের আলোয় পাহাড় সে এক অপূর্ব সুন্দর চেহারা ধারন করেছে; রোদের সোনালী
আভায় ঝলমলিয়ে উঠেছে চারিদিকের গাছের পাতা, পাখিরা আনন্দে মেতে উঠে গান ধরেছে। সে
যেন এক মধুর অনুভব যা আমি লিখে প্রকাশ করতে পারব না, সে অনুভব সেই দৃশ্য যেন
আমাদের এক রোমাঞ্চিত শিহরণ দিয়ে জাগিয়ে তুলল।
![]() |
Way of Neora Valley |
![]() |
Fire-tailed Sunbird |
সকালের প্রাতরাশ
সেরে তৈরী হলাম পাখি দেখার জন্য। আমরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে হাঁটতে থাকি; আমরা কজন
ছিলাম এই বিষয়ে একেবারে নূতন, তাই আমাদের পাখি দেখানো থেকে শুরু করে তার নাম,
স্বভাব, প্রকৃতি সম্ভন্ধে বোঝান শ্রী অপূর্ব চক্রবর্তী মহাশয়। আমরা দেখতে পাই যেমন
Fire-tailed Sunbird, Green-tailed Sunbird, Refous
Sibia, Stripe throated Yuhina, Chestnut crowned laughing Thrust, White-throated
Fantail, Scralet Finch, Refous winged Funvetta, আরও অনেক। দিনের
শেষে ঝুলি ভরা বেশ কিছু নতুন পাখির নাম ও কিছু ছবি সংগ্রহ করে সন্ধে বেলার কনকনে
ঠাণ্ডার অপেক্ষায় রইতাম। সন্ধেবেলাটা ছিল আমাদের সারাদিনের শেষের আড্ডা কাটত এক
অন্য মেজাজে, মাঝখানে একটি Camp fire তার চারিদিকে আমরা সবাই
বসে, যেখানে কারা কি কি পাখি দেখেছে তা নিয়ে চলত আলোচনা। আড্ডা শেষে রাতের খাবার
খেয়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়ি রাত্রিনিদ্রার জন্য।
![]() |
Maroon-backed Accentor |
১৪ই মার্চও আমরা
আগের দিনের দল পাহাড় থেকে নিচের দিকে যাই পাখির খোঁজে, এদিন আমরা দেখতে পাই Rose
Finch, Blue-fronted Redstart, Maroon-backed Accentor, Brown Bulfinch, Small
Niltava, Brown-throated Treecreeper, Rusty fronted Barwing আরও
অনেক কিছু। প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার হেঁটে আসার পর গতদিনের মত বাকি সময় কাটে আড্ডায়
গল্পে।
১৫ই মার্চ দিনটি
আমার কাছে বেশ স্মরণীয়। সকালের খাবার সঙ্গে নিয়ে আমদের দল চলল নেওড়া নদীরদিকে।
রাস্তাটি বেশ কঠিন, তাছাড়াও যেহেতু আমি আগে কখন পাহাড় চড়িনি বা Trek
করিনি তার ফলে আমার কাছে পথটা বেশ দুর্গম ঠেকছিল। বনের মধ্যে দিয়ে
এঁকেবেঁকে রাস্তা চলেছে নদীর দিকে, কখন চরাই কখন উঠরাই। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর হঠাৎ
এক জায়গায় এসে দাড়িয়ে পড়ি, অপূর্ববাবু দেখতে পান দুটি পাখি পাশাপাশি বসে আছে। আমরা
কাছে যেতেই উনি আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠেন Wards Trogon, যদিও
কিছু বোঝবার আগে ছবি তোলার চেষ্টা করি কারণ তিনি বলেন এটি বেশ দুর্লভ পাখি। প্রথমে
স্ত্রী ও পুরুষ পাখিটি একসঙ্গে থাকলেও আমরা পথ এগোতেই পুরুষ পাখিটি বহু দূরে উড়ে
যায় ফলে শুধু স্ত্রী পাখিরই চিত্র লেন্সবন্ধি করতে সক্ষম হই। আমরা নদীর কাছে থেকে
বিদায় নিয়ে ফেরার পথে আবার দেখতে পাই উনি বসে আছেন এবং সেই Wards Trogon (female)-কে শেষবারের মত দেখে ক্যাম্পে ফিরি। বেশ
অনেকক্ষণই দেখা দিলেও কুয়াশাছন্ন ও মেঘলা আবহাওয়ার জন্য খুব ভাল চিত্র না পেলেও
প্রাণভরে দেখে আমরা সবাই ভীষণ খুশি। সেবারের মত শেষ সন্ধ্যের আড্ডা দিয়ে পরদিন অর্থাৎ
১৬ই মার্চ বাড়ি ফেরার জন্য গোছগাছ করে রাখি কারণ সকাল সকাল বেরতে হবে ও সেইমত
সকালে গাড়ি ধরে আসি নিউ জলপাইগুড়ি রাতের কাঞ্চনকন্যা ট্রেন ধরে ১৭ই মার্চ বাড়ি
ফিরি।
![]() |
Wards Trogon (f) |
![]() |
Blue-fronted Redstart |
নতুন নতুন পাখি
দেখা, আড্ডা, গল্প, গানে এই কটাদিন যেন আমাদের নিমেষেই কেটে গেল। আমাদের লিস্টে
জায়গা পেল কমপক্ষে একশটির মত পাখি যার বেশিরভাগটি আমার অজানা ছিল। পাহাড়ের প্রকৃতি
আবহাওয়া যে কত সুন্দর মনোরম সেটা ওখানে না গেলে হয়ত জানতেই পারতাম না। অজানা কত কি
আছে তা এখন জানিনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন আছে তা আমরা দেখছি ভাল লাগে, সেটা
রক্ষ্যা করাও আমাদের কর্তব্য। আগামী দিনের কথা ভেবে, এই প্রাচুর্যটাকে পরবর্তী
প্রজন্মের কাছে বয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের সবাইকেই যতটা সম্ভব প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক
প্রাচুর্যটাকে রক্ষা করতে হবে। আমরা যদি প্রকৃতিকে ভালোবাসি, রক্ষা করি; সেও
আমাদের জন্য তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতা উপহার হিসাবে তুলে ধরবে।